বর্তমান ডিজিটাল যুগে আর্থিক লেনদেন ও পরিষেবা গ্রহণের ধরনে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের অন্যতম এক অনুষঙ্গ হলো মোবাইল লোন অ্যাপস। স্মার্টফোনের সহজলভ্যতা এবং দ্রুতগতির ইন্টারনেটের প্রসারের সাথে সাথে এই অ্যাপগুলো ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, বিশেষত তরুণ প্রজন্ম এবং যাদের প্রথাগত ব্যাংকিং পরিষেবার সুযোগ সীমিত, তাদের কাছে। কিন্তু এই আপাত সহজলভ্য ঋণ কি আসলেই আর্থিক মুক্তির পথ, নাকি এক নতুন সংকট ডেকে আনছে? একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে, আমি এই বিষয়টির চুলচেরা বিশ্লেষণ করে এর সুযোগ এবং ঝুঁকিগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করব।
মোবাইল লোন অ্যাপসের উত্থান
বিগত দশকে বিশ্বব্যাপী ফিনটেক (FinTech) শিল্পের অভাবনীয় উন্নতি সাধিত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় মোবাইল লোন অ্যাপস বা ডিজিটাল ঋণদানকারী প্ল্যাটফর্মগুলোর আত্মপ্রকাশ। প্রথাগত ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে যে দীর্ঘ প্রক্রিয়া, নথিপত্রের জটিলতা এবং সময়ের দীর্ঘসূত্রিতা দেখা যায়, মোবাইল লোন অ্যাপস সেখানে এক বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, যেখানে জনসংখ্যার একটি বড় অংশ এখনও প্রথাগত ব্যাংকিং সেবার আওতার বাইরে, সেখানে এই অ্যাপগুলো আর্থিক অন্তর্ভুক্তির এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে বলে মনে করা হয়।
দ্রুত নগদায়নের চাহিদা, তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটানোর তাগিদ এবং ব্যবহারকারী-বান্ধব ইন্টারফেস এই অ্যাপগুলোর জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ। কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে যখন অনেকেই আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছিলেন, তখন এই অ্যাপগুলোর ব্যবহার আরও বৃদ্ধি পায়।
সুবিধাসমূহ: দ্রুত, সহজ, অ্যাকসেসিবল
মোবাইল লোন অ্যাপস ব্যবহারের বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে যা অস্বীকার করার উপায় নেই:
১. দ্রুততা: এই অ্যাপগুলোর প্রধান আকর্ষণ হলো ঋণের আবেদন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে টাকা হাতে পাওয়া পর্যন্ত পুরো বিষয়টি অত্যন্ত দ্রুত সম্পন্ন হয়। অনেক ক্ষেত্রে কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঋণের অনুমোদন পাওয়া যায় এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে টাকা ব্যাংক একাউন্ট বা মোবাইল ওয়ালেটে চলে আসে। জরুরি চিকিৎসা, আকস্মিক বিল পরিশোধ বা অন্য কোনো তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে এই দ্রুততা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
২. সহজ প্রক্রিয়া: প্রথাগত ঋণ ব্যবস্থার মতো জটিল ডকুমেন্টেশন বা দীর্ঘ ফর্ম পূরণের ঝামেলা এখানে নেই। সাধারণত জাতীয় পরিচয়পত্র, সেলফি এবং কিছু প্রাথমিক তথ্য দিয়েই ঋণের জন্য আবেদন করা যায়। পুরো প্রক্রিয়াটি স্মার্টফোনের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়, ফলে ঋণগ্রহীতাকে কোথাও সশরীরে উপস্থিত হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
৩. অ্যাকসেসিবিলিটি (সহজলভ্যতা): এই অ্যাপগুলো যেকোনো সময়, যেকোনো স্থান থেকে ব্যবহার করা যায়। যাদের প্রথাগত ব্যাংকের শাখা কাছাকাছি নেই বা যারা কর্মব্যস্ততার কারণে ব্যাংকে যাওয়ার সুযোগ পান না, তাদের জন্য এটি একটি বড় সুবিধা। এছাড়া, যাদের কোনো পূর্বের ঋণের ইতিহাস (credit history) নেই, তাদেরও কিছু কিছু অ্যাপ ঋণ দিয়ে থাকে, যা নতুন ঋণগ্রহীতাদের জন্য একটি সুযোগ তৈরি করে।
৪. ছোট অংকের ঋণ: বেশিরভাগ অ্যাপ প্রাথমিক পর্যায়ে ছোট অংকের ঋণ প্রদান করে, যা অনেকের স্বল্পমেয়াদী প্রয়োজন মেটাতে সাহায্য করে। সময়মতো পরিশোধ করলে ঋণের সীমা বৃদ্ধি পাওয়ারও সুযোগ থাকে।
বিপদ: উচ্চ সুদ, গোপন ফি, হয়রানি
মোবাইল লোন অ্যাপসের চাকচিক্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে অসংখ্য বিপদ, যা ব্যবহারকারীদের মারাত্মক আর্থিক ও মানসিক সংকটে ফেলতে পারে।
১. অস্বাভাবিক উচ্চ সুদের হার: এই অ্যাপগুলোর ঋণের সুদের হার প্রথাগত ব্যাংকিং ব্যবস্থার চেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই অস্বাভাবিক রকমের বেশি। অনেক সময় বার্ষিক সুদের হার (Annual Percentage Rate – APR) ২০০% থেকে ৪০০% বা তারও বেশি হতে দেখা যায়। স্বল্পমেয়াদী ঋণ হওয়ায় গ্রাহকরা অনেক সময় মোট সুদের পরিমাণ কম মনে করলেও, এই উচ্চ হার তাদের দ্রুত ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে ফেলে। অর্থনীতিতে যাকে বলে ‘ঋণের দুষ্টচক্র’ (debt trap), সেখানে একবার প্রবেশ করলে বেরিয়ে আসা কঠিন হয়ে পড়ে।
২. গোপন বা প্রসেসিং ফি: অনেক অ্যাপে মূল সুদের হারের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের গোপন ফি, যেমন – প্রসেসিং ফি, লেট পেমেন্ট ফি, রোলওভার ফি ইত্যাদি চার্জ করা হয়, যা ঋণের মোট খরচকে আরও বাড়িয়ে দেয়। অনেক সময় এই ফিগুলো সম্পর্কে গ্রাহককে স্বচ্ছভাবে জানানো হয় না।
৩. তথ্য চুরি ও অপব্যবহারের ঝুঁকি: বেশিরভাগ লোন অ্যাপ ব্যবহারকারীর ফোন থেকে কন্টাক্ট লিস্ট, গ্যালারি, মেসেজ এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত তথ্যে অ্যাক্সেস চায়। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে এই তথ্য ব্যবহার করে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা, এমনকি ব্ল্যাকমেইল করার মতো ঘটনাও ঘটে। ব্যক্তিগত তথ্যের এমন অবাধ অ্যাক্সেস ডিজিটাল নিরাপত্তার দিক থেকে একটি বড় ঝুঁকি।
৪. হয়রানি ও আগ্রাসী ঋণ আদায় পদ্ধতি: ঋণ পরিশোধে সামান্য বিলম্ব হলেই অ্যাপগুলোর পক্ষ থেকে বা তাদের নিয়োজিত এজেন্টদের কাছ থেকে চরম হয়রানির শিকার হতে হয় গ্রাহকদের। অনবরত ফোন কল, হুমকিমূলক বার্তা, এমনকি পরিচিতজনদের কাছে ফোন করে মানহানির চেষ্টাও করা হয়। এই ধরনের আগ্রাসী ঋণ আদায় পদ্ধতি গ্রাহকের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
যাচাইবিহীন ঋণগ্রহণের ঝুঁকি
মোবাইল লোন অ্যাপসগুলো প্রায়শই ঋণগ্রহীতার ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা সঠিকভাবে যাচাই না করেই ঋণ প্রদান করে। প্রথাগত ব্যাংকগুলো যেখানে ক্রেডিট স্কোর, আয়ের উৎস, পূর্বের লেনদেনের ইতিহাস ইত্যাদি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে, সেখানে অনেক অ্যাপ শুধু প্রাথমিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই ঋণ অনুমোদন করে। এর ফলে এমন ব্যক্তিরাও ঋণ গ্রহণ করেন যাদের নিয়মিত আয়ের উৎস নেই বা যারা ইতোমধ্যেই অন্য কোনো ঋণে জর্জরিত।
এই যাচাইবিহীন ঋণগ্রহণের পরিণাম ভয়াবহ। একদিকে যেমন ঋণগ্রহীতা সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে উচ্চ সুদ ও জরিমানার কবলে পড়েন, অন্যদিকে খেলাপী ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেলে তা সামগ্রিক আর্থিক ব্যবস্থার জন্যও ঝুঁকি তৈরি করে।
নৈতিক ও আইনি সমস্যা
মোবাইল লোন অ্যাপসগুলোর কার্যক্রম ঘিরে বেশ কিছু নৈতিক ও আইনি প্রশ্ন উঠছে:
১. অস্বচ্ছতা: ঋণের শর্তাবলী, সুদের হার, অন্যান্য চার্জ এবং ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহারের নীতিমালা সম্পর্কে গ্রাহকদের পরিষ্কারভাবে না জানানো একটি বড় নৈতিক সমস্যা।
২. নিয়ন্ত্রণের অভাব: অনেক দেশেই এই ধরনের অ্যাপস পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট ও শক্তিশালী नियामक কাঠামো এখনও পুরোপুরিভাবে গড়ে ওঠেনি। ফলে, কিছু অসাধু চক্র এই সুযোগের অপব্যবহার করে গ্রাহকদের শোষণ করছে।
৩. তথ্যের গোপনীয়তা লঙ্ঘন: ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অনেক অ্যাপ এই তথ্যের গোপনীয়তা বজায় রাখে না, যা প্রচলিত তথ্য সুরক্ষা আইনের পরিপন্থী।
৪. চুক্তির অসমতা: ঋণ চুক্তির শর্তাবলী সাধারণত অ্যাপ প্রদানকারী সংস্থার পক্ষেই একতরফাভাবে তৈরি করা হয়, যেখানে গ্রাহকের দর কষাকষির কোনো সুযোগ থাকে না। এটি একটি অসম চুক্তি (contract of adhesion) পরিস্থিতি তৈরি করে।
সচেতনতার অভাব
মোবাইল লোন অ্যাপস ব্যবহারকারীদের একটি বড় অংশই এর সুদূরপ্রসারী পরিণতি সম্পর্কে সঠিকভাবে অবগত নন। আর্থিক সাক্ষরতার অভাব, ডিজিটাল প্রতারণা সম্পর্কে অসচেতনতা এবং তাৎক্ষণিক অর্থের প্রয়োজনীয়তা অনেক সময় গ্রাহকদের বিচারবুদ্ধি লোপ করে দেয়। চটকদার বিজ্ঞাপন এবং সহজলভ্যতার মোহে তারা এমন সব শর্তে ঋণ গ্রহণ করেন, যা পরবর্তী সময়ে তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।
বিশ্বব্যাপী পরিস্থিতি
মোবাইল লোন অ্যাপসের সমস্যা শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। ভারত, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনসহ বিভিন্ন দেশে এই অ্যাপগুলোর দৌরাত্ম্য এবং এর ফলে সৃষ্ট সংকট লক্ষ্য করা গেছে। বিভিন্ন দেশ তাদের नियामक সংস্থাগুলোকে সক্রিয় করে এসব অ্যাপের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে। উদাহরণস্বরূপ, গুগল প্লে স্টোর তাদের নীতিমালায় পরিবর্তন এনে নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ না করলে লোন অ্যাপস নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপ নিয়েছে। ভারতে রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া (RBI) ডিজিটাল ঋণদানের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও গ্রাহক সুরক্ষার জন্য কঠোর নির্দেশিকা জারি করেছে।
বাংলাদেশে বাস্তব কেস স্টাডি
বাংলাদেশেও মোবাইল লোন অ্যাপসের ব্যবহার বাড়ছে এবং এর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রতারণা ও হয়রানির ঘটনা। গণমাধ্যমে প্রায়শই এমন খবর প্রকাশিত হয় যেখানে দেখা যায়, উচ্চ সুদের ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন অনেকে। বিশেষত তরুণ সমাজ, শিক্ষার্থী এবং নিম্ন আয়ের মানুষেরা সহজে ঋণ পাওয়ার আশায় এসব অ্যাপের দ্বারস্থ হচ্ছেন।
উদাহরণস্বরূপ কিছু পরিস্থিতি:
- নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী: ঢাকার এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থী টিউশনির টাকা সময়মতো না পাওয়ায় হলের খরচ মেটাতে একটি মোবাইল অ্যাপ থেকে ৫,০০০ টাকা ঋণ নেন। সাত দিনের মধ্যে পরিশোধের শর্তে তাকে ৬,৫০০ টাকা দিতে বলা হয়। নির্দিষ্ট সময়ে টাকা জোগাড় করতে না পারায় প্রতিদিন ৩০০ টাকা করে জরিমানা ধার্য করা হয়। এক পর্যায়ে ঋণের পরিমাণ ২০,০০০ টাকা ছাড়িয়ে যায় এবং অ্যাপ কর্তৃপক্ষ তার ফোনের কন্টাক্ট লিস্টে থাকা বন্ধুদের ফোন করে আপত্তিকর কথা বলতে শুরু করে।
- ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী: জরুরি ভিত্তিতে কিছু মাল কেনার জন্য একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী একটি অ্যাপ থেকে ২০,০০০ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। প্রসেসিং ফি এবং অন্যান্য চার্জ বাদ দিয়ে তিনি হাতে পান প্রায় ১৮,০০০ টাকা, কিন্তু পরিশোধ করতে হয় ২৫,০০০ টাকা, মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে। এই চক্র থেকে বের হতে তাকে আরও কয়েকটি অ্যাপ থেকে ঋণ নিতে হয়, যা তাকে গভীর ঋণের জালে আবদ্ধ করে ফেলে।
এইসব ঘটনা প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশে মোবাইল লোন অ্যাপসগুলোর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে কিছু নির্দেশনা জারি করেছে এবং লাইসেন্সবিহীন আর্থিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সতর্ক করেছে। তবে মাঠ পর্যায়ে এর প্রয়োগ এবং তদারকি আরও জোরদার করা প্রয়োজন। গ্রাহকদেরও সচেতন হতে হবে এবং যেকোনো অ্যাপ থেকে ঋণ নেওয়ার আগে এর বৈধতা ও শর্তাবলী ভালোভাবে যাচাই করে নিতে হবে।
নিরাপদ ব্যবহারের টিপস
মোবাইল লোন অ্যাপস ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলে সম্ভাব্য বিপদ থেকে অনেকাংশে রক্ষা পাওয়া সম্ভব:
১. অ্যাপের উৎস ও বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই করুন: কোনো অ্যাপ ডাউনলোড করার আগে সেটি গুগল প্লে স্টোর বা অ্যাপল অ্যাপ স্টোরের মতো নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে ডাউনলোড করুন। অ্যাপটির রিভিউ, রেটিং এবং ব্যবহারকারীদের মন্তব্য ভালোভাবে পড়ুন। দেখুন অ্যাপটির কোনো সুপরিচিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (যেমন ব্যাংক বা লাইসেন্সপ্রাপ্ত NBFI) সাথে সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা।
২. শর্তাবলী মনোযোগ দিয়ে পড়ুন: ঋণের আবেদন করার আগে সুদের হার, প্রসেসিং ফি, লেট পেমেন্ট চার্জ, পরিশোধের সময়সীমা এবং অন্যান্য শর্তাবলী খুব ভালোভাবে পড়ে ও বুঝে নিন। কোনো অস্পষ্টতা থাকলে বা শর্তাবলী অন্যায্য মনে হলে সেই অ্যাপ ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন।
৩. অতিরিক্ত ব্যক্তিগত তথ্যের অ্যাক্সেস দেবেন না: অ্যাপটি আপনার ফোনের কন্টাক্ট লিস্ট, গ্যালারি, লোকেশন বা অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় তথ্যের অ্যাক্সেস চাইলে সতর্ক হোন। একটি লোন অ্যাপের জন্য এই ধরনের অ্যাক্সেসের সাধারণত প্রয়োজন হয় না।
৪. সুদের হার তুলনা করুন: একাধিক অ্যাপ বা প্রথাগত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সুদের হারের সাথে তুলনা করে দেখুন। যেখান থেকে সবচেয়ে কম সুদে এবং স্বচ্ছ শর্তে ঋণ পাওয়া যায়, সেটি বেছে নিন।
৫. শুধুমাত্র প্রয়োজন অনুযায়ী ঋণ নিন: লোভে পড়ে বা অপ্রয়োজনে ঋণ গ্রহণ করবেন না। আপনার ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বিবেচনা করে ঋণের পরিমাণ নির্ধারণ করুন।
৬. নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিন: সম্ভব হলে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত বা লাইসেন্সপ্রাপ্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত অ্যাপ থেকেই ঋণ নিন। এদের কার্যক্রম সাধারণত নিয়ন্ত্রিত এবং গ্রাহক সুরক্ষার ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো থাকে।
৭. সময়মতো পরিশোধ করুন: ঋণ গ্রহণ করলে তা সময়মতো পরিশোধ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করুন। এতে অতিরিক্ত জরিমানা ও হয়রানি থেকে বাঁচা যাবে এবং আপনার ক্রেডিট স্কোরও ভালো থাকবে (যেখানে প্রযোজ্য)।
৮. সন্দেহজনক কিছু দেখলে অভিযোগ করুন: কোনো অ্যাপের কার্যক্রমে প্রতারণা বা হয়রানির শিকার হলে বা সন্দেহজনক কিছু দেখলে অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ (যেমন – বাংলাদেশ ব্যাংক, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, পুলিশ) এর কাছে অভিযোগ জানান।
টেকসই আর্থিক পরিকল্পনায় মোবাইল লোনের স্থান
মোবাইল লোন অ্যাপস নিঃসন্দেহে একটি উদ্ভাবনী আর্থিক পণ্য, যা দ্রুত ও সহজে অর্থায়নের সুযোগ তৈরি করেছে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রেও এর একটি ইতিবাচক ভূমিকা থাকতে পারে, বিশেষত যদি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় এবং দায়িত্বশীলতার সাথে ব্যবহার করা হয়। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে, বিশেষ করে অনেক অ্যাপের অনৈতিক কার্যক্রমের কারণে, এটি অনেকের জন্য “সুযোগ” না হয়ে “ধ্বংসের” কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে আমার পর্যবেক্ষণ হলো, মোবাইল লোন তখনই সুফল বয়ে আনবে যখন এর সাথে স্বচ্ছতা, গ্রাহক সুরক্ষা এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার কঠোর নজরদারি নিশ্চিত হবে। উচ্চ সুদের হার এবং আগ্রাসী ঋণ আদায় পদ্ধতির মতো বিষয়গুলো সমাধান না করা গেলে এটি আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
টেকসই আর্থিক পরিকল্পনায় স্বল্পমেয়াদী, উচ্চ সুদের ঋণের স্থান খুবই সীমিত হওয়া উচিত। জরুরি এবং অপরিহার্য প্রয়োজন ছাড়া এ ধরনের ঋণ এড়িয়ে চলাই শ্রেয়। আর্থিক সাক্ষরতা বৃদ্ধি, সঞ্চয়ের প্রবণতা তৈরি এবং দায়িত্বশীল ঋণ গ্রহণ আচরণের ওপর জোর দিতে হবে। সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর উচিত একটি সুষম নীতিমালা প্রণয়ন করা, যা ফিনটেক উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করবে এবং একইসাথে গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষা করবে। মনে রাখতে হবে, কোনো আর্থিক পণ্যই নিজে থেকে ভালো বা খারাপ নয়; এর ব্যবহার এবং নিয়ন্ত্রণই নির্ধারণ করে এটি আশীর্বাদ হবে নাকি অভিশাপ। তাই, মোবাইল লোন অ্যাপস ব্যবহারের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি আপনাকেই নিতে হবে, তবে সেটি অবশ্যই পর্যাপ্ত তথ্য ও সচেতনতার ভিত্তিতে। আপনার আর্থিক ভবিষ্যৎ আপনারই হাতে।