বাজেট করে ঋণ পরিশোধের প্র্যাকটিক্যাল উদাহরণ

ঋণ আধুনিক জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষা, চিকিৎসা, গৃহনির্মাণ থেকে শুরু করে ছোটখাটো প্রয়োজন মেটাতেও আমরা প্রায়শই ঋণের দ্বারস্থ হই। কিন্তু অপরিকল্পিত ঋণ অনেক সময় গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়ায়, কেড়ে নেয় মানসিক শান্তি। এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসার অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার হলো একটি সুচিন্তিত বাজেট। এই ব্লগ পোস্টে আমরা আলোচনা করবো কীভাবে একটি কার্যকর বাজেট তৈরি করে منظمভাবে ঋণ পরিশোধ করা যায় এবং আর্থিক স্বাধীনতার পথে এগিয়ে যাওয়া যায়।

বাজেটিং ও ঋণ সম্পর্ক

বাজেটিং এবং ঋণ পরিশোধ – এই দুটি বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাজেট হলো আপনার আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য বিধানের একটি পরিকল্পনা। যখন আপনি ঋণগ্রস্ত থাকেন, তখন এই পরিকল্পনা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। একটি সঠিক বাজেট আপনাকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা দেয়:

  • আয়-ব্যয়ের পূর্ণাঙ্গ চিত্র: আপনার মোট আয় কত এবং কোন কোন খাতে কত খরচ হচ্ছে, তার একটি স্পষ্ট হিসাব পাওয়া যায়।
  • অপ্রয়োজনীয় ব্যয় চিহ্নিতকরণ: বাজেট পর্যালোচনার মাধ্যমে আপনি সেসব ব্যয় চিহ্নিত করতে পারবেন যা কমানো বা পরিহার করা সম্ভব।
  • ঋণ পরিশোধের জন্য অর্থ বরাদ্দ: বাজেটে ঋণ পরিশোধের জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রতি মাসে বরাদ্দ রাখা যায়, যা ঋণমুক্তির প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।
  • আর্থিক শৃঙ্খলা: বাজেট মেনে চললে জীবনযাত্রায় একটি আর্থিক শৃঙ্খলা আসে, যা ভবিষ্যতের জন্যেও অত্যন্ত জরুরি।

এককথায়, বাজেট হলো ঋণ পরিশোধের পথে আপনার রোডম্যাপ। এটি ছাড়া ঋণমুক্তির যাত্রা অনেকটাই অনির্দিষ্ট ও কঠিন হয়ে পড়ে।

সাধারন একজনের আয়-ব্যয়ের বিবরণ

আসুন, একটি কাল্পনিক চরিত্র ‘জনাব করিম’-এর আয়-ব্যয়ের হিসাব দিয়ে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করি। জনাব করিম একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তার মাসিক আয় ও সম্ভাব্য ব্যয়ের একটি চিত্র নিচে দেওয়া হলো:

মাসিক আয়:

  • বেতন: ৫০,০০০ টাকা
  • অন্যান্য ভাতা (যেমন মোবাইল বিল, যাতায়াত): ৫,০০০ টাকা
  • মোট আয়: ৫৫,০০০ টাকা

মাসিক ব্যয় (বাজেট করার আগে):

  • বাড়ি ভাড়া (সার্ভিস চার্জসহ): ১৫,০০০ টাকা
  • খাবার ও মুদি খরচ: ১২,০০০ টাকা
  • সন্তানের স্কুলের বেতন ও যাতায়াত: ৭,০০০ টাকা
  • পরিবহন খরচ (অফিস যাতায়াত): ৩,০০০ টাকা
  • ইউটিলিটি বিল (বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, ইন্টারনেট): ৩,৫০০ টাকা
  • চিকিৎসা খরচ (আকস্মিক): ২,০০০ টাকা (গড়ে)
  • পোশাক ও ব্যক্তিগত পরিচর্যা: ৩,০০০ টাকা
  • বিনোদন (সিনেমা দেখা, বাইরে খাওয়া): ৪,০০০ টাকা
  • মোবাইল রিচার্জ ও ব্যক্তিগত ইন্টারনেট: ১,৫০০ টাকা
  • সামাজিকতা ও উপহার: ২,০০০ টাকা
  • মোট প্রাথমিক ব্যয়: ৫০,০০০ টাকা

এখন, জনাব করিমের একটি পার্সোনাল লোন আছে যার মাসিক কিস্তি (EMI) ৭,০০০ টাকা এবং একটি ক্রেডিট কার্ডের বিল পরিশোধ করতে হয় মাসে গড়ে ৩,০০০ টাকা।

এই পরিস্থিতিতে, তার মোট ব্যয় দাঁড়ায় (৫০,০০০ + ৭,০০০ + ৩,০০০) = ৬০,০০০ টাকা। কিন্তু তার আয় ৫৫,০০০ টাকা। অর্থাৎ, প্রতি মাসে তার ৫,০০০ টাকার ঘাটতি থাকছে, যা হয়তো তিনি অন্য কোনোভাবে ধার করে বা ক্রেডিট কার্ডের আরও ব্যবহার করে মেটাচ্ছেন, যা তাকে আরও ঋণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এখানেই একটি পরিকল্পিত বাজেটের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

প্রয়োজনীয়তা vs বিলাসিতা

বাজেট তৈরির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো আপনার খরচগুলোকে ‘প্রয়োজনীয়তা’ এবং ‘বিলাসিতা’ এই দুই ভাগে ভাগ করা।

  • প্রয়োজনীয়তা (Needs): এগুলো হলো বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য খরচ, যা কোনোভাবেই বাদ দেওয়া সম্ভব নয়। যেমন: খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, যাতায়াত (কাজের জন্য)।
  • বিলাসিতা (Wants): এগুলো হলো সেসব খরচ যা জীবনযাত্রার মান বাড়ায় কিন্তু অপরিহার্য নয়। যেমন: দামি রেস্টুরেন্টে খাওয়া, ব্র্যান্ডের পোশাক, ঘন ঘন ঘুরতে যাওয়া, অপ্রয়োজনীয় গ্যাজেট।

জনাব করিমের ব্যয়ের তালিকা থেকে প্রয়োজনীয়তা ও বিলাসিতা আলাদা করা যাক:

প্রয়োজনীয়তা:

  • বাড়ি ভাড়া: ১৫,০০০ টাকা
  • খাবার ও মুদি খরচ: ১২,০০০ টাকা
  • সন্তানের স্কুলের বেতন ও যাতায়াত: ৭,০০০ টাকা
  • পরিবহন খরচ (অফিস যাতায়াত): ৩,০০০ টাকা
  • ইউটিলিটি বিল: ৩,৫০০ টাকা
  • চিকিৎসা খরচ: ২,০০০ টাকা
  • লোনের কিস্তি: ৭,০০০ টাকা
  • ক্রেডিট কার্ডের ন্যূনতম পরিশোধ: (ধরা যাক ১,০০০ টাকা ন্যূনতম পরিশোধ, বাকিটা বিলাসিতার কারণে জমেছে)

বিলাসিতা/কমানো যেতে পারে এমন খরচ:

  • পোশাক ও ব্যক্তিগত পরিচর্যা: (অতিরিক্ত কেনাকাটা কমানো যেতে পারে)
  • বিনোদন: ৪,০০০ টাকা (কমানো বা বাদ দেওয়া যেতে পারে)
  • মোবাইল রিচার্জ ও ব্যক্তিগত ইন্টারনেট: (প্যাকেজ পরিবর্তন বা কম ব্যবহার)
  • সামাজিকতা ও উপহার: (বাজেট অনুযায়ী সীমিত করা)
  • ক্রেডিট কার্ডের বাকি বিল: (বিলাসিতামূলক কেনাকাটার ফলে জমা হওয়া বিল)

এই বিভাজনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, যখন আপনি ঋণ পরিশোধের জন্য অতিরিক্ত অর্থ বের করতে চাইবেন, তখন বিলাসবহুল বা কম প্রয়োজনীয় খরচগুলো কমিয়েই তা করতে হবে। এর মানে এই নয় যে জীবন থেকে সব আনন্দ বাদ দিতে হবে, বরং একটি ভারসাম্য খুঁজে বের করতে হবে।

Step-by-step বাজেট তৈরি

একটি কার্যকর বাজেট তৈরির জন্য নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে:

১. সমস্ত আয়ের উৎস একত্রিত করুন: মাসের শুরুতে আপনার হাতে কত টাকা আসছে (বেতন, পার্ট-টাইম কাজ, বাড়ি ভাড়া ইত্যাদি) তার সঠিক হিসাব করুন। জনাব করিমের ক্ষেত্রে এটি ৫৫,০০০ টাকা।

২. সমস্ত খরচ ট্র্যাক করুন: কমপক্ষে এক মাস ধরে আপনার প্রতিটি ছোট-বড় খরচ লিখে রাখুন। একটি নোটবুক, এক্সেল শিট বা বাজেট অ্যাপ ব্যবহার করতে পারেন। এর মধ্যে মুদি খরচ, যাতায়াত, বিল, বিনোদন – সবকিছু অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

৩. খরচগুলোকে ক্যাটাগরিতে ভাগ করুন: আপনার খরচগুলোকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে (যেমন: বাড়ি ভাড়া, খাবার, পরিবহন, স্বাস্থ্য, বিনোদন, ঋণ পরিশোধ ইত্যাদি) ভাগ করুন। এতে কোন খাতে কত খরচ হচ্ছে তা বোঝা সহজ হবে।

৪. প্রয়োজনীয়তা ও বিলাসিতা চিহ্নিত করুন: প্রতিটি খরচের ক্যাটাগরিকে প্রয়োজনীয়তা ও বিলাসিতা হিসেবে আলাদা করুন, যেমনটি আগে আলোচনা করা হয়েছে।

৫. বাস্তবসম্মত বাজেট তৈরি করুন: এবার প্রতিটি ক্যাটাগরির জন্য একটি যৌক্তিক খরচের সীমা নির্ধারণ করুন। ঋণ পরিশোধের লক্ষ্য থাকলে, বিলাসিতার খরচ কমিয়ে সেই অর্থ ঋণ পরিশোধের জন্য বরাদ্দ করুন। একটি ‘শূন্য-ভিত্তিক বাজেট’ (Zero-Based Budget) পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারেন, যেখানে আপনার মোট আয় থেকে মোট পরিকল্পিত ব্যয় বিয়োগ করলে শূন্য হবে (আয় – ব্যয় = ০)। এর মানে হলো, আপনার প্রতিটি টাকাকে কোনো না কোনো খাতের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে, সেটা সঞ্চয় হোক বা খরচ।

জনাব করিমের উদাহরণে একটি সম্ভাব্য সংশোধিত বাজেট:

মোট আয়: ৫৫,০০০ টাকা
পরিকল্পিত ব্যয়:
বাড়ি ভাড়া: ১৫,০০০ টাকা
খাবার ও মুদি: ১০,০০০ টাকা (২,০০০ টাকা সাশ্রয়)
সন্তানের স্কুলের বেতন: ৭,০০০ টাকা
পরিবহন: ৩,০০০ টাকা
ইউটিলিটি বিল: ৩,৫০০ টাকা
চিকিৎসা: ২,০০০ টাকা
পোশাক ও ব্যক্তিগত পরিচর্যা: ১,৫০০ টাকা (১,৫০০ টাকা সাশ্রয়)
বিনোদন: ১,০০০ টাকা (৩,০০০ টাকা সাশ্রয়)
মোবাইল ও ইন্টারনেট: ১,০০০ টাকা (৫০০ টাকা সাশ্রয়)
সামাজিকতা ও উপহার: ১,০০০ টাকা (১,০০০ টাকা সাশ্রয়)
মোট নিয়মিত ব্যয়: ৪৪,৫০০ টাকা
অবশিষ্ট অর্থ (আয় – নিয়মিত ব্যয়): ৫৫,০০০ – ৪৪,৫০০ = ১০,৫০০ টাকা

৬. ঋণ পরিশোধের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি:

জনাব করিমের হাতে এখন ১০,৫০০ টাকা আছে। তিনি এই টাকা তার ঋণ পরিশোধের জন্য ব্যবহার করতে পারেন। তার পার্সোনাল লোনের কিস্তি ৭,০০০ টাকা এবং ক্রেডিট কার্ডের বিল পরিশোধের জন্য তিনি ৩,৫০০ টাকা বরাদ্দ করতে পারেন। এতে তার ক্রেডিট কার্ডের ঋণও দ্রুত কমবে।

৭. জরুরী তহবিল (Emergency Fund): বাজেটে অল্প কিছু হলেও একটি জরুরী তহবিলের জন্য বরাদ্দ রাখা বুদ্ধিমানের কাজ। অপ্রত্যাশিত খরচ (যেমন হঠাৎ অসুস্থতা বা চাকরি হারানো) এই তহবিল থেকে মেটানো যায়, ফলে নতুন করে ঋণ করতে হয় না।

মাসিক বাজেটে কিস্তি অন্তর্ভুক্ত করা

ঋণ থাকলে, তার মাসিক কিস্তি (EMI) আপনার বাজেটের একটি অপরিহার্য অংশ। এটিকে কোনোভাবেই ঐচ্ছিক খরচ হিসেবে দেখা যাবে না।

  • কিস্তিকে অগ্রাধিকার দিন: বেতন পাওয়ার সাথে সাথেই ঋণের কিস্তির টাকা আলাদা করে ফেলুন। সম্ভব হলে, অটো-ডেবিট বা স্ট্যান্ডিং ইন্সট্রাকশনের মাধ্যমে কিস্তি পরিশোধের ব্যবস্থা করুন। এতে দেরিতে পরিশোধের জরিমানা এড়ানো যাবে এবং আপনার ক্রেডিট স্কোরও ভালো থাকবে।
  • অতিরিক্ত পরিশোধের সুযোগ: যদি বাজেটে সম্ভব হয়, তাহলে ঋণের কিস্তির চেয়ে কিছু টাকা বেশি পরিশোধ করার চেষ্টা করুন। এতে আপনার ঋণের পরিমাণ দ্রুত কমবে এবং সুদের বোঝাও লাঘব হবে। জনাব করিম যেমন ১০,৫০০ টাকা ঋণ পরিশোধের জন্য বরাদ্দ করেছেন, যেখানে তার ন্যূনতম প্রয়োজন ছিল (৭,০০০+৩,০০০) = ১০,০০০ টাকা। অতিরিক্ত ৫০০ টাকাও দীর্ঘমেয়াদে কাজে দেবে।

উদাহরণস্বরূপ, জনাব করিম যদি তার পার্সোনাল লোনের ৭,০০০ টাকার কিস্তির পরিবর্তে প্রতি মাসে ৮,০০০ টাকা পরিশোধ করতে পারেন, তাহলে তার লোন নির্ধারিত সময়ের আগেই পরিশোধ হয়ে যাবে এবং মোট সুদের পরিমাণও কমবে।

Actual vs Planned ব্যয়ের তুলনা

বাজেট তৈরি করা যুদ্ধের অর্ধেক জেতার মতো। বাকি অর্ধেক হলো সেই বাজেট নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও মেনে চলা।

  • প্রতিদিনের খরচ লিখে রাখুন: সারা মাস ধরে আপনার প্রকৃত খরচগুলো meticulosly লিখে রাখুন। বিভিন্ন বাজেট ট্র্যাকিং অ্যাপ এক্ষেত্রে খুব সহায়ক হতে পারে।
  • সাপ্তাহিক বা মাসিক পর্যালোচনা: প্রতি সপ্তাহে বা মাসের শেষে আপনার পরিকল্পিত ব্যয়ের সঙ্গে প্রকৃত ব্যয়ের তুলনা করুন।
    • কোন কোন খাতে আপনার খরচ পরিকল্পনা মতো হয়েছে?
    • কোন খাতে খরচ বেশি বা কম হয়েছে?
    • যদি কোনো খাতে খরচ বেশি হয়ে থাকে, তার কারণ কী? (অপ্রত্যাশিত খরচ, নাকি পরিকল্পনায় দুর্বলতা?)
  • প্রয়োজন অনুযায়ী বাজেট সমন্বয় করুন: পর্যালোচনার পর যদি দেখেন কোনো খাতে নিয়মিত বেশি খরচ হচ্ছে এবং তা কমানো সম্ভব নয় (যেমন: হঠাৎ করে সন্তানের স্কুলের বেতন বেড়ে গেছে), তাহলে অন্য কোনো খাতের খরচ কমিয়ে অথবা আয় বাড়ানোর চেষ্টা করে বাজেটকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করুন। বাজেট একটি জীবন্ত দলিলের মতো, সময়ের সাথে সাথে এর পরিবর্তন ও পরিমার্জনের প্রয়োজন হতে পারে।

জনাব করিম যদি মাস শেষে দেখেন যে তার বিনোদন খাতের ১,০০০ টাকার বাজেট অতিক্রম করে ২,০০০ টাকা খরচ হয়ে গেছে, তাহলে পরের মাসে তাকে হয় এই খাতে খরচ কমাতে হবে, অথবা অন্য কোনো কম গুরুত্বপূর্ণ খাত থেকে ১,০০০ টাকা সাশ্রয় করতে হবে। এই তুলনার মাধ্যমেই আর্থিক শৃঙ্খলা গড়ে ওঠে।

ছোট সঞ্চয় দিয়ে বড় ঋণ পরিশোধ

“বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তোলে সাগর অতল” – এই প্রবাদটি ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রেও সত্য। বাজেট করার মাধ্যমে আপনি যখন ছোট ছোট অপ্রয়োজনীয় খরচগুলো বাদ দেবেন বা কমাবেন, তখন মাস শেষে কিছু টাকা সাশ্রয় হবে। এই ছোট ছোট সঞ্চয় একত্রিত করে একটি বড় অঙ্কের অর্থ তৈরি হতে পারে, যা দিয়ে আপনি বড় ঋণ পরিশোধে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করতে পারবেন।

উদাহরণ:

ধরুন, বাজেট করার ফলে জনাব করিম প্রতি মাসে নিম্নলিখিত সাশ্রয় করতে পারলেন:

  • বাইরে খাওয়া কমানো: ২,০০০ টাকা
  • অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা বন্ধ: ১,৫০০ টাকা
  • বিনোদন খরচ কমানো: ১,০০০ টাকা
  • মোট মাসিক সঞ্চয়: ৪,৫০০ টাকা

এই ৪,৫০০ টাকা হয়তো মাসিক কিস্তির অতিরিক্ত হিসেবে তিনি তার সবচেয়ে বেশি সুদের হারের ঋণটিতে (যেমন ক্রেডিট কার্ড) পরিশোধ করতে পারেন। অথবা, কয়েক মাস জমিয়ে একটি বড় থোক টাকা সরাসরি ঋণের মূল পরিমাণে জমা দিতে পারেন। এতে ঋণের মেয়াদ কমে আসবে এবং মোট সুদের পরিমাণও হ্রাস পাবে।

ধরা যাক, জনাব করিমের ক্রেডিট কার্ডে ৫০,০০০ টাকার ঋণ আছে যার বার্ষিক সুদের হার ৩৬%। তিনি যদি শুধু ন্যূনতম পরিশোধ করতে থাকেন, তাহলে এই ঋণ পরিশোধ করতে অনেক বছর লেগে যাবে এবং প্রচুর সুদ দিতে হবে। কিন্তু যদি তিনি প্রতি মাসে অতিরিক্ত ৪,৫০০ টাকা এই ক্রেডিট কার্ডে দেন, তাহলে খুব দ্রুত এই উচ্চ সুদের ঋণ থেকে মুক্তি পাবেন।

একাধিক ঋণের সমন্বয়

অনেকের ক্ষেত্রেই একাধিক ঋণ থাকতে পারে – যেমন পার্সোনাল লোন, ক্রেডিট কার্ডের ঋণ, হোম লোন ইত্যাদি। এক্ষেত্রে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা দরকার।

১. তালিকা তৈরি করুন: আপনার সমস্ত ঋণের একটি তালিকা তৈরি করুন। প্রতিটি ঋণের বিপরীতে তার বর্তমান ব্যালেন্স, সুদের হার এবং মাসিক ন্যূনতম কিস্তি উল্লেখ করুন।

২. অগ্রাধিকার নির্ধারণ করুন: কোন ঋণটি আগে পরিশোধ করবেন তা নির্ধারণ করতে দুটি জনপ্রিয় পদ্ধতি রয়েছে:

ডেবট স্নোবল (Debt Snowball Method): এই পদ্ধতিতে আপনি আপনার সবচেয়ে ছোট অংকের ঋণটি আগে সম্পূর্ণ পরিশোধ করার উপর জোর দেবেন, সুদের হার যাই হোক না কেন। একটি ঋণ সম্পূর্ণ পরিশোধ করতে পারলে আপনি মানসিক তৃপ্তি ও উৎসাহ পাবেন, যা পরবর্তী ঋণগুলো পরিশোধে প্রেরণা যোগাবে। ছোট ঋণটি শোধ হয়ে গেলে, সেই ঋণের জন্য বরাদ্দ অর্থ পরবর্তী তুলনামূলক বড় ঋণের কিস্তির সাথে যোগ করে পরিশোধ করবেন।

ডেবট অ্যাভালান्च (Debt Avalanche Method): এই পদ্ধতিতে আপনি সবচেয়ে বেশি সুদের হারের ঋণটি আগে পরিশোধ করার উপর মনোযোগ দেবেন। গাণিতিকভাবে, এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে আপনি মোট সুদের পরিমাণে সবচেয়ে বেশি সাশ্রয় করতে পারবেন। উচ্চ সুদের ঋণটি পরিশোধ হয়ে গেলে, সেই ঋণের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ পরবর্তী উচ্চ সুদের ঋণে যোগ করবেন।

জনাব করিমের ক্ষেত্রে, তার পার্সোনাল লোনের (ধরা যাক সুদের হার ১৪%) চেয়ে ক্রেডিট কার্ডের ঋণের (সুদের হার ৩৬%) সুদের হার অনেক বেশি। তাই, ‘ডেবট অ্যাভালান्च’ পদ্ধতি অনুযায়ী তার উচিত হবে ক্রেডিট কার্ডের ঋণটি আগে পরিশোধ করার জন্য অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করা।

৩. ঋণ একত্রীকরণ (Debt Consolidation): যদি আপনার একাধিক উচ্চ সুদের ঋণ থাকে, তাহলে আপনি ‘ঋণ একত্রীকরণ’-এর কথা ভাবতে পারেন। এর মানে হলো, বিভিন্ন ছোট ছোট ঋণকে একটি বড় ঋণে পরিণত করা, যার সুদের হার তুলনামূলকভাবে কম হতে পারে। যেমন, একটি কম সুদের পার্সোনাল লোন নিয়ে সেই টাকা দিয়ে সমস্ত ক্রেডিট কার্ডের বিল পরিশোধ করে ফেলা। এতে একাধিক কিস্তির ঝামেলা কমে একটি কিস্তিতে পরিণত হয় এবং সুদের বোঝাও কিছুটা লাঘব হতে পারে। তবে, নতুন ঋণের শর্তাবলী ভালোভাবে জেনে নেওয়া জরুরি।

সফল বাজেটিং এর উদাহরণ

আসুন, মিসেস আয়েশার একটি কাল্পনিক কিন্তু বাস্তবসম্মত উদাহরণ দেখি। মিসেস আয়েশা একজন স্কুল শিক্ষিকা, যার দুটি ছোট অঙ্কের পার্সোনাল লোন এবং একটি ক্রেডিট কার্ডে বেশ কিছু টাকা ঋণ ছিল। সব মিলিয়ে তার মাসিক কিস্তি আসত প্রায় ১৫,০০০ টাকা, যা তার আয়ের একটা বড় অংশ।

তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন একটি বাজেট তৈরি করবেন।

  • প্রথম ধাপ: তিনি এক মাস ধরে তার সমস্ত খরচ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিখে রাখলেন।
  • দ্বিতীয় ধাপ: তিনি দেখলেন যে প্রতি মাসে প্রায় ৪,০০০-৫,০০০ টাকা তিনি এমন সব খাতে খরচ করছেন যা সহজেই কমানো সম্ভব (যেমন, সপ্তাহে তিন দিন রেস্টুরেন্টে খাওয়া, অপ্রয়োজনীয় পোশাক কেনা, ঘন ঘন কফি শপে যাওয়া)।
  • তৃতীয় ধাপ: তিনি একটি কঠোর বাজেট তৈরি করলেন। রেস্টুরেন্টে খাওয়া কমিয়ে সপ্তাহে একদিন করলেন, পোশাক কেনা কমিয়ে দিলেন এবং অন্যান্য ছোটখাটো অপ্রয়োজনীয় খরচ বাদ দিলেন।
  • চতুর্থ ধাপ: এর ফলে তিনি প্রতি মাসে প্রায় ৪,০০০ টাকা সাশ্রয় করতে সক্ষম হলেন। এই অতিরিক্ত টাকা তিনি ‘ডেবট স্নোবল’ পদ্ধতি অনুসরণ করে তার সবচেয়ে ছোট পার্সোনাল লোনটিতে দেওয়া শুরু করলেন।
  • ফলাফল: ৬ মাসের মধ্যে তার ছোট লোনটি পরিশোধ হয়ে গেল। এতে তিনি দারুণভাবে অনুপ্রাণিত হলেন। এরপর সেই ছোট লোনের কিস্তির টাকা এবং অতিরিক্ত সাশ্রয় করা টাকা যোগ করে তিনি ক্রেডিট কার্ডের ঋণ পরিশোধে মনোযোগ দিলেন। দেড় বছরের মাথায় মিসেস আয়েশা তার ক্রেডিট কার্ড ও অন্য পার্সোনাল লোনটিও পরিশোধ করে সম্পূর্ণ ঋণমুক্ত হলেন।

এই উদাহরণটি দেখায় যে, সঠিক পরিকল্পনা, শৃঙ্খলা এবং দৃঢ় সংকল্প থাকলে বাজেটের মাধ্যমে ঋণ পরিশোধ করা অবশ্যই সম্ভব।

উপসংহার: নিয়মিততা ও শৃঙ্খলা

বাজেট করে ঋণ পরিশোধের যাত্রা কোনো ১০০ মিটার স্প্রিন্ট নয়, এটি একটি ম্যারাথন। এখানে সাফল্য পেতে হলে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নিয়মিততা ও শৃঙ্খলা।

  • ধৈর্য ধরুন: রাতারাতি কোনো পরিবর্তন আসবে না। ঋণমুক্ত হতে সময় লাগবে। হতাশ না হয়ে ধৈর্য ধরে বাজেট অনুসরণ করুন।
  • নিয়মিত পর্যালোচনা ও সমন্বয়: প্রতি মাসে বাজেট পর্যালোচনা করুন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তাতে পরিবর্তন আনুন। জীবনযাত্রা পরিবর্তনশীল, তাই আপনার বাজেটও নমনীয় হওয়া উচিত।
  • ছোট ছোট সাফল্য উদযাপন করুন: যখন একটি ছোট লক্ষ্য পূরণ হবে (যেমন, একটি ছোট ঋণ পরিশোধ বা নির্দিষ্ট পরিমাণ সঞ্চয়), তখন নিজেকে পুরস্কৃত করুন (তবে বাজেটের মধ্যে থেকে)। এটি আপনাকে দীর্ঘমেয়াদে অনুপ্রাণিত রাখবে।
  • ভুল থেকে শিখুন: যদি কোনো মাসে বাজেট অনুযায়ী চলতে না পারেন, তাহলে ভেঙে পড়বেন না। কেন এমন হলো তা বিশ্লেষণ করুন এবং পরের মাস থেকে আবার নতুন উদ্যমে শুরু করুন।

মনে রাখবেন, একটি সুপরিকল্পিত বাজেট শুধু আপনাকে ঋণমুক্ত হতেই সাহায্য করে না, বরং এটি আপনাকে আপনার অর্থের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এনে দেয় এবং একটি সুরক্ষিত ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের ভিত্তি স্থাপন করে। আর্থিক স্বাধীনতা অর্জন কঠিন মনে হতে পারে, কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা এবং দৃঢ় মনোবলের মাধ্যমে এটি অবশ্যই অর্জনযোগ্য। আপনার ঋণমুক্তির যাত্রায় এই আলোচনা কিছুটা হলেও সহায়ক হবে বলে আশা রাখি।

Leave a Reply