ঋণ নেয়ার আগে যে ৭টি প্রশ্ন নিজেকে করতে হবে

আধুনিক জীবনে আর্থিক প্রয়োজন মেটাতে ঋণের সাহায্য নেওয়া একটি সাধারণ ঘটনা। ব্যবসা সম্প্রসারণ, বাড়ির স্বপ্ন পূরণ, সন্তানের উচ্চশিক্ষা, চিকিৎসা ব্যয় অথবা অপ্রত্যাশিত কোনো জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় অনেকেই ঋণের দ্বারস্থ হন। কিন্তু ঋণ যেমন আশীর্বাদ বয়ে আনতে পারে, তেমনি অপরিকল্পিত বা অসচেতনভাবে নেওয়া ঋণ মারাত্মক আর্থিক দুর্দশার কারণও হতে পারে। একজন প্রফেশনাল অর্থনীতিবিদ হিসেবে, আমি মনে করি ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্তটি অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে নেওয়া উচিত। এই প্রক্রিয়ায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নিজেকে করা অপরিহার্য। এই প্রশ্নগুলো শুধু ঋণের বোঝা সঠিকভাবে পরিচালণা করতেই সাহায্য করবে না, বরং আপনার আর্থিক ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত রাখতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

চলুন, বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক সেই ৭টি প্রশ্ন, যা ঋণ নেওয়ার আগে নিজেকে অবশ্যই জিজ্ঞেস করা উচিত।

১. আমি এই অর্থ কেন নিচ্ছি?

সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: ঋণের মূল উদ্দেশ্য পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত করা। এটি কি কোনো উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ, নাকি শুধুমাত্র ভোগ বা বিলাসিতার জন্য?

বিস্তারিত প্রেক্ষাপট:

যেকোনো আর্থিক সিদ্ধান্তের পেছনে একটি সুস্পষ্ট ‘কেন’ থাকা আবশ্যক। ঋণ নেওয়ার কারণটি যদি হয় কোনো সম্পদ সৃষ্টি (যেমন ব্যবসা শুরু বা সম্প্রসারণ, গৃহ নির্মাণ) বা দক্ষতা বৃদ্ধি (যেমন উচ্চশিক্ষা), তবে সেই ঋণকে ‘ভালো ঋণ’ বা উৎপাদনশীল ঋণ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। কারণ, এ ধরনের ঋণ ভবিষ্যতে আপনার আয় বাড়াতে বা সম্পদ সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। যেমন, একটি নতুন মেশিন কেনার জন্য ব্যবসায়িক ঋণ নিলে সেটি উৎপাদন বাড়িয়ে মুনাফা বৃদ্ধিতে সাহায্য করতে পারে।

অন্যদিকে, যদি ঋণের কারণ হয় শুধুমাত্র ভোগব্যয় (যেমন দামি মোবাইল ফোন কেনা, বিলাসবহুল ছুটি কাটানো), যা থেকে ভবিষ্যতে কোনো আর্থিক রিটার্ন আসার সম্ভাবনা নেই, তবে সেটিকে ‘অনুৎপাদনশীল ঋণ’ বা ‘খারাপ ঋণ’ বলা যেতে পারে। অর্থনীতিতে, সুযোগ ব্যয়ের (Opportunity Cost) একটি ধারণা রয়েছে। যখন আপনি একটি খাতে অর্থ ব্যয় করেন, তখন অন্য খাতে সেই অর্থ ব্যয়ের সুযোগটি হারান। অপ্রয়োজনীয় ভোগব্যয়ের জন্য ঋণ নিলে, সেই অর্থ হয়তো আরও জরুরি বা লাভজনক কোনো খাতে বিনিয়োগের সুযোগ নষ্ট করে। তাই, ঋণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকাটা প্রথম এবং প্রধানতম বিষয়। উদ্দেশ্য যদি অস্পষ্ট বা তাৎক্ষণিক আবেগের বশবর্তী হয়, তবে সেই ঋণ এড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয়।

২. এই ঋণটি কি আমার প্রয়োজন নাকি চাওয়া?

সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: ঋণের মাধ্যমে যা পেতে চাইছেন, তা কি আপনার মৌলিক চাহিদা পূরণ করবে, নাকি এটি কেবলই একটি আকাঙ্ক্ষা?

বিস্তারিত প্রেক্ষাপট:

অর্থনীতিতে ‘চাহিদা’ (Need) এবং ‘আকাঙ্ক্ষা’ (Want) – এই দুটি বিষয়ের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার মতো বিষয়গুলো মৌলিক চাহিদা। এগুলোর জন্য ঋণ নেওয়া অনেক সময় অপরিহার্য হয়ে পড়ে। যেমন, হঠাৎ কোনো বড় ধরনের চিকিৎসার প্রয়োজন হলে এবং পর্যাপ্ত সঞ্চয় না থাকলে ঋণ একটি গুরুত্বপূর্ণ সমাধান হতে পারে।

অন্যদিকে, নতুন মডেলের গাড়ি কেনা (যখন পুরোনোটি ভালোভাবেই চলছে), লেটেস্ট গ্যাজেট সংগ্রহ করা, বা ঘন ঘন দামী রেস্টুরেন্টে খাওয়া – এগুলো চাওয়ার তালিকাভুক্ত। অর্থনীতিবিদ হিসেবে আমি বলতে চাই, চাওয়ার পেছনে ঋণ করা প্রায়শই আর্থিক বিচ্যুতির লক্ষণ। চাওয়ার কোনো সীমা নেই, এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক বিষয়। একটি আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলে আরেকটি জন্ম নেয়। যদি প্রতিটি চাওয়ার জন্য ঋণ নিতে থাকেন, তাহলে খুব দ্রুত আপনি ঋণের জালে আটকা পড়বেন, যা আপনার দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক স্থিতিশীলতাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করবে। প্রয়োজন এবং চাওয়ার মধ্যে ভারসাম্য স্থাপন করা বুদ্ধিমানের কাজ। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া, শুধুমাত্র আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য ঋণ গ্রহণ এড়িয়ে চলুন।

৩. এটি ফেরত দিতে আমার কত সময় লাগবে?

সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: ঋণের মেয়াদ বা টেনিওর (Tenure) সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখা এবং তা আপনার আর্থিক পরিকল্পনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা, তা যাচাই করা।

বিস্তারিত প্রেক্ষাপট:

ঋণের পরিমাণ এবং সুদের হারের পাশাপাশি ঋণের মেয়াদও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দীর্ঘমেয়াদী ঋণে মাসিক কিস্তির (EMI) পরিমাণ কম হতে পারে, যা আপাতদৃষ্টিতে স্বস্তিদায়ক মনে হলেও মোট সুদের পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। অন্যদিকে, স্বল্পমেয়াদী ঋণে মাসিক কিস্তির পরিমাণ বেশি হলেও মোট সুদ কম পরিশোধ করতে হয়।

আপনাকে বিবেচনা করতে হবে, কতদিন ধরে আপনি এই ঋণের বোঝা বহন করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন। আপনার বর্তমান বয়স, আয়ের উৎস, ভবিষ্যৎ আর্থিক পরিকল্পনা (যেমন সন্তানের পড়াশোনা, নিজের অবসর) ইত্যাদি বিষয় মাথায় রেখে ঋণের মেয়াদ নির্বাচন করা উচিত। যদি মনে করেন, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে আপনার আয়ের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসতে পারে (যেমন পদোন্নতি বা নতুন ব্যবসা থেকে আয় শুরু), তাহলে হয়তো স্বল্পমেয়াদী ঋণ নিয়ে দ্রুত পরিশোধ করা সম্ভব। কিন্তু যদি আয় বৃদ্ধির তেমন সম্ভাবনা না থাকে বা অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদী দায়বদ্ধতা থাকে, সেক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ বিবেচনা করা যেতে পারে, তবে মোট সুদের পরিমাণ সম্পর্কে অবশ্যই অবগত থাকতে হবে। টাইম ভ্যালু অফ মানি (Time Value of Money) বা অর্থের সময়মূল্য বিষয়টি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। আজ যে টাকা পরিশোধ করছেন, তার চেয়ে ভবিষ্যতে পরিশোধ করা টাকার প্রকৃত মূল্য কম হতে পারে (মুদ্রাস্ফীতির কারণে), কিন্তু সুদের কারণে মোট টাকার অঙ্ক বেড়ে যায়।

৪. মাসিক কিস্তির চাপ নিতে পারবো তো?

সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: আপনার বর্তমান মাসিক আয় ও ব্যয়ের হিসাব করে ঋণের মাসিক কিস্তি (EMI) পরিশোধ করার সক্ষমতা যাচাই করা।

বিস্তারিত প্রেক্ষাপট:

এটি ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বাস্তবসম্মত এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর একটি। ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান আপনার আয়ের কত শতাংশ পর্যন্ত কিস্তি হিসেবে গ্রহণযোগ্য, তার একটি সাধারণ হিসাব (Debt-to-Income Ratio বা DTI) করে থাকে। কিন্তু তাদের হিসাবের বাইরেও আপনার ব্যক্তিগত বাজেট এবং আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়টি আপনাকেই ভাবতে হবে।

একটি বিস্তারিত মাসিক বাজেট তৈরি করুন। আপনার নিয়মিত আয় (বেতন, ব্যবসা থেকে লাভ ইত্যাদি) এবং অত্যাবশ্যকীয় ব্যয় (বাড়ি ভাড়া, খাবার, যাতায়াত, সন্তানের স্কুলের বেতন, চিকিৎসা ইত্যাদি) তালিকাভুক্ত করুন। এরপর দেখুন, হাতে কত টাকা অবশিষ্ট থাকে। প্রস্তাবিত ঋণের মাসিক কিস্তি কি সেই অবশিষ্ট টাকার মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্যে সংকুলান হচ্ছে? অর্থনীতিবিদরা সাধারণত পরামর্শ দেন যে, সমস্ত ঋণ পরিশোধের কিস্তি মিলিয়ে আপনার নিট আয়ের ৩৫-৪০% এর বেশি হওয়া উচিত নয়। যদি কিস্তির পরিমাণ এর থেকে বেশি হয়, তাহলে আপনার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মান প্রভাবিত হতে পারে, জরুরি অবস্থার জন্য সঞ্চয় করা কঠিন হয়ে পড়বে এবং আপনি একটি costante আর্থিক চাপের মধ্যে থাকবেন। মনে রাখবেন, অপ্রত্যাশিত খরচ যেকোনো সময়ই আসতে পারে। তাই, কিস্তির চাপ সামলানোর জন্য আপনার বাজেটে কিছুটা ‘বাফার’ বা余裕 রাখা জরুরি।

৫. সুদের হার ও অতিরিক্ত খরচ কত?

সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: ঋণের মোট খরচ নিরূপণ করা, যার মধ্যে শুধু সুদের হারই নয়, বরং অন্যান্য প্রসেসিং ফি, চার্জ ইত্যাদিও অন্তর্ভুক্ত।

বিস্তারিত প্রেক্ষাপট:

ঋণ নেওয়ার সময় অনেকেই শুধু বিজ্ঞাপনে দেখানো প্রাথমিক সুদের হার দেখেন। কিন্তু এর বাইরেও অনেক ধরনের খরচ বা চার্জ থাকতে পারে, যা ঋণের মোট ব্যয়কে (Effective Interest Rate বা APR – Annual Percentage Rate) উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দেয়। যেমন:

  • প্রসেসিং ফি: আবেদনপত্র যাচাই ও ঋণ অনুমোদনের জন্য এই ফি নেওয়া হয়।
  • ডকুমেন্টেশন চার্জ: বিভিন্ন কাগজপত্র তৈরির খরচ।
  • লিগ্যাল ও ভ্যালুয়েশন ফি: বিশেষত গৃহঋণ বা মর্টগেজ ঋণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
  • ইনস্যুরেন্স প্রিমিয়াম: কিছু ঋণের সাথে বাধ্যতামূলক জীবন বিমা বা সম্পদ বিমা সংযুক্ত থাকতে পারে।
  • আর্লি সেটেলমেন্ট বা প্রি-পেমেন্ট চার্জ: যদি নির্দিষ্ট মেয়াদের আগেই ঋণ শোধ করতে চান, তাহলে কিছু ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান এর জন্য জরিমানা আরোপ করে।
  • লেট পেমেন্ট ফি: নির্দিষ্ট তারিখে কিস্তি দিতে ব্যর্থ হলে জরিমানা।

সুদের হার কি স্থির (Fixed) নাকি পরিবর্তনশীল (Floating/Variable), সেটাও জেনে নেওয়া জরুরি। স্থির সুদের হারে পুরো মেয়াদে কিস্তির পরিমাণ একই থাকে, যা বাজেট করতে সুবিধা দেয়। অন্যদিকে, পরিবর্তনশীল সুদের হার বাজারের পরিস্থিতির সাথে ওঠা-নামা করে, যা আপনার কিস্তির পরিমাণকেও প্রভাবিত করতে পারে। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবগুলো তুলনা করার সময় শুধু নামমাত্র সুদের হার না দেখে, এই সমস্ত অতিরিক্ত খরচ এবং শর্তাবলীও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করুন। APR বা বার্ষিক শতাংশ হার তুলনা করা একটি ভালো অভ্যাস, কারণ এটি ঋণের প্রায় সমস্ত খরচকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি তুলনামূলক চিত্র দেয়।

৬. বিকল্প কোনো উপায় কি আছে?

সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: ঋণ নেওয়ার আগে অন্য কোনো আর্থিক সংস্থান বা সমাধানের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা।

বিস্তারিত প্রেক্ষাপট:

ঋণ সবসময়ই একটি দায়বদ্ধতা। তাই, ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার আগে বিকল্প সব পথ খতিয়ে দেখা উচিত। হয়তো একটু চেষ্টা করলে বা অন্যভাবে পরিকল্পনা করলে ঋণ ছাড়াই প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হতে পারে। কিছু বিকল্প হতে পারে:

  • ব্যক্তিগত সঞ্চয় ব্যবহার: যদি আপনার কিছু সঞ্চয় থাকে, যা অলসভাবে পড়ে আছে, সেটি ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে কোনো সুদ গুনতে হবে না।
  • খরচ কমানো বা বিলম্বিত করা: যে কারণে ঋণ নিতে চাইছেন, সেটি কি অত্যাবশ্যকীয়? কিছুদিনের জন্য কি সেই খরচ স্থগিত রাখা যায়? অথবা আপনার জীবনযাত্রার কিছু বিলাসিতা কমিয়ে কি অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব?
  • অব্যবহৃত সম্পদ বিক্রি: আপনার এমন কোনো সম্পদ থাকতে পারে (যেমন পুরোনো গয়না, অব্যবহৃত জমি বা গাড়ি) যা বিক্রি করে অর্থের সংস্থান করা যেতে পারে।
  • আয় বৃদ্ধি: অতিরিক্ত আয়ের জন্য পার্ট-টাইম কাজ বা ফ্রিল্যান্সিংয়ের সুযোগ খুঁজে দেখা।
  • পরিবার বা বন্ধুদের থেকে সুদমুক্ত বা স্বল্পসুদে ঋণ: যদি সম্ভব হয়, বিশ্বস্ত নিকটাত্মীয় বা বন্ধুর থেকে সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রেও একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তিপত্র থাকা ভালো, যাতে সম্পর্কের অবনতি না ঘটে।

অর্থনীতিতে প্রতিটি সিদ্ধান্তের একটি ‘সুযোগ ব্যয়’ (Opportunity Cost) থাকে। ঋণ নিলে তার সুদ পরিশোধ করতে হয়, যা অন্য কোনো লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করা যেত। তাই, সব বিকল্প বিবেচনা করে যদি দেখেন ঋণ নেওয়াই সর্বোত্তম এবং একমাত্র পথ, তবেই সেদিকে অগ্রসর হোন।

৭. এই ঋণ আমার ভবিষ্যতের উপর কী প্রভাব ফেলবে?

সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা: বর্তমানের প্রয়োজন মেটাতে নেওয়া ঋণ আপনার দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক লক্ষ্য এবং ভবিষ্যৎ জীবনের উপর কেমন প্রভাব ফেলতে পারে, তা মূল্যায়ন করা।

বিস্তারিত প্রেক্ষাপট:

ঋণের প্রভাব শুধুমাত্র বর্তমান মাসিক বাজেটের উপরই সীমাবদ্ধ থাকে না, এটি আপনার সুদূরপ্রসারী আর্থিক পরিকল্পনা এবং জীবনের গুণগত মানের উপরও গভীর ছাপ ফেলে। যেমন:

  • ক্রেডিট স্কোর: সময়মতো ঋণের কিস্তি পরিশোধ করলে আপনার ক্রেডিট স্কোর বা ঋণযোগ্যতার ইতিহাস উন্নত হয়, যা ভবিষ্যতে অন্য কোনো প্রয়োজনে (যেমন বাড়ি বা গাড়ি কেনা) সহজে ও ভালো শর্তে ঋণ পেতে সাহায্য করে। কিন্তু কিস্তিখেলাপি হলে ক্রেডিট স্কোর খারাপ হয়ে যায়, যা ভবিষ্যৎ ঋণ প্রাপ্তিকে কঠিন করে তোলে।
  • সঞ্চয় ও বিনিয়োগ ক্ষমতা: ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে যদি আপনার সঞ্চয় বা বিনিয়োগ করার ক্ষমতা কমে যায়, তাহলে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যগুলো (যেমন সন্তানের উচ্চশিক্ষা, নিজের অবসরকালীন পরিকল্পনা) ব্যাহত হতে পারে।
  • আর্থিক স্বাধীনতা: অতিরিক্ত ঋণের বোঝা আপনার আর্থিক স্বাধীনতা খর্ব করে। নতুন কোনো ব্যবসায়িক সুযোগ বা ব্যক্তিগত উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে ঋণের চাপ আপনাকে পিছিয়ে রাখতে পারে।
  • মানসিক চাপ: constantes ঋণের চিন্তা মানসিক চাপের সৃষ্টি করতে পারে, যা আপনার স্বাস্থ্য ও পারিবারিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

অন্যদিকে, কিছু ঋণ (যেমন গৃহঋণ) দীর্ঘমেয়াদে সম্পদ সৃষ্টি করে এবং কর সুবিধাও প্রদান করতে পারে, যা আপনার আর্থিক ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক। তাই, ঋণ নেওয়ার আগে এর সম্ভাব্য ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবগুলো বিচক্ষণতার সাথে মূল্যায়ন করুন। এই ঋণ কি আপনাকে আপনার বৃহত্তর জীবন লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, নাকি তা অর্জনে বাধা সৃষ্টি করবে – এই প্রশ্নের সৎ উত্তর খোঁজা জরুরি।

নিজেকে প্রস্তুত করার গাইডলাইন:

ঋণ নেওয়ার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে নিজেকে সঠিকভাবে প্রস্তুত করা অত্যাবশ্যক। নিচে একটি সংক্ষিপ্ত গাইডলাইন দেওয়া হলো:

১. সম্পূর্ণ আর্থিক চিত্র তৈরি করুন: আপনার মাসিক আয়, ব্যয়, সঞ্চয়, বর্তমান দায়বদ্ধতা ইত্যাদি বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ করুন।

২. ক্রেডিট রিপোর্ট পরীক্ষা করুন: ঋণ আবেদন করার আগে নিজের ক্রেডিট স্কোর জেনে নিন। কোনো ভুল তথ্য থাকলে তা সংশোধনের উদ্যোগ নিন।

৩. বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অফার তুলনা করুন: শুধুমাত্র একটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর না করে একাধিক জায়গা থেকে ঋণের শর্তাবলী (সুদের হার, ফি, মেয়াদ ইত্যাদি) সংগ্রহ করুন ও তুলনা করুন।

৪. ছোট অক্ষরে লেখা শর্তাবলী পড়ুন: ঋণের চুক্তিপত্রের প্রতিটি ধারা, বিশেষ করে জরিমানা, চার্জ এবং অন্যান্য শর্তাবলী মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। কোনো কিছু বুঝতে অসুবিধা হলে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন।

৫. একটি বাস্তবসম্মত পরিশোধ পরিকল্পনা তৈরি করুন: আপনার বাজেটের সাথে সঙ্গতি রেখে কীভাবে নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করবেন, তার একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা করুন।

৬. জরুরি অবস্থার জন্য তহবিল: ঋণ নেওয়ার পরেও যাতে অপ্রত্যাশিত কোনো আর্থিক ধাক্কা সামলাতে পারেন, সেজন্য একটি জরুরি তহবিল (সাধারণত ৩-৬ মাসের জীবনযাত্রার খরচের সমপরিমাণ) রাখার চেষ্টা করুন।

৭. প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন: যদি আর্থিক পরিকল্পনা বা ঋণ সংক্রান্ত জটিল বিষয় বুঝতে অসুবিধা হয়, তবে একজন যোগ্য আর্থিক পরামর্শকের সাহায্য নিতে দ্বিধা করবেন না।

উপসংহার

ঋণ নিজে থেকে ভালো বা খারাপ নয়; এর ব্যবহারই একে ইতিবাচক বা নেতিবাচক করে তোলে। উপরের প্রশ্নগুলো নিজেকে করার মাধ্যমে এবং বিস্তারিত প্রেক্ষাপটগুলো অনুধাবন করার মাধ্যমে আপনি একটি সচেতন ও সুবিবেচিত ঋণগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। মনে রাখবেন, ঋণ যেন আপনার আর্থিক অগ্রগতির পথে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে, বোঝা হিসেবে নয়। সচেতন ঋণগ্রহণ আপনার বর্তমান প্রয়োজন যেমন মেটাবে, তেমনই আপনার ভবিষ্যৎ আর্থিক জীবনের ভিত্তিকেও শক্তিশালী করবে। প্রতিটি আর্থিক সিদ্ধান্ত হোক পরিকল্পিত ও দূরদর্শী – এই প্রত্যাশাই রইল।

Leave a Reply